কাতার বিশ্বকাপ ২০২২, সমকামিতা এবং আমার মৃত ভাই

 কাতার বিশ্বকাপের আনন্দে সবাই বুদ হয়ে আছে। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই খেলার মাঠে মদ খাওয়াসহ কাতারের অনেক বিধিনিষেধ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেসব নিয়ম ফিফা মেনে নেয়ায় এদেশের অনেকে আনন্দিত হয়েছে। খেলার মধ্যে ধর্ম টেনে আনাটা আমার জন্য অস্বস্তিকর একটি কাজ। মানসিক শান্তি নষ্ট হয়। কিন্তু আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমানদের কোনোকিছুই ধর্ম ছাড়া চলে না। আমার জানামতে খেলাকে ঘিরে যত ঘটনা ঘটে যেমন-সরাসরি সম্প্রচার,বিজ্ঞাপন, খেলোয়াড়দের পোশাক বেশিরভাগই ধর্ম সমর্থন করে না। সেটা অনেক বড় বিতর্ক। বিশ্বকাপে কয়েকটা দলের অধিনায়ক সমকামীদের সমর্থনে আয়োজকদের নিষেধ সত্ত্বেও ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড পরে মাঠে নামতে চেয়েছিল । কিন্তু সেই সিন্ধান্ত থেকে তারা সরে এসেছে। কারণ কেউ আর্মব্যান্ড পরে নামলে তাকে হলুদ কার্ড দেখানোর ঘোষণা দিয়েছে ফিফা।


আমাদের সমাজে ঘটা অনেকগুলো বিতর্কিত বিষয়ের মধ্যে সমকামিতা একটি। আর এর কারনেই দেড় বছর আগে আমার ভাই খুন হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রশাসনের থেকে একটা রিপোর্ট আদালতে যায় নি। তাই আমি অপেক্ষা করছি। আর সমকামিতা বিষয়টা জানার চেষ্টা করছি।
মোটামুটি বুঝতে পারার পরথেকেই আমি সমকামীতাকে ঘৃনার চোখে দেখতাম। আমাকে বোঝার পর থেকে এটা নিয়ে খুব বেশি মস্তিষ্ক খাটাতে হয়নি। শুধু ঘৃনা করতে হবে এটুকুই শেখানো হয়েছে।
ভাইয়ার ব্যপারটা প্রথম কবে শুনি সেটা আমার স্পষ্ট মনে নেই। ভাইয়া সম্পর্কের কথাটা প্রথম মায়ের কাছেই বলেছিল। মা আমাকে বলেছিল ভাইয়া একটা সম্পর্কে জড়িয়েছে কিন্তু মেয়েটার কখনও বাচ্চা হবে না। তখন আমি অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি।
ঘটনাক্রমে ভাইয়ার মুখ থেকে মানুষটার কথা শুনি এবং তার ছবিও দেখি। সমাজের চোখে যাকে হিজড়া বলে সেরকমই দেখতে। আমার কাছে এই সম্পর্কগুলো তখন খুব স্বাভাবিক মনে হতো না। যদিও তখন বুঝতাম অনেককিছুই কিন্তু উদার ছিলাম না, এটুকু নিশ্চিত। সম্পর্কটা মেনে নিলেও হেটারোসেক্সুয়াল মনের মধ্যে এরকম একটা সম্পর্কের সেক্স কল্পনা করতে গেলেই প্রচন্ড অস্বস্তি হতো, সেখান থেকেই ঘৃনার জন্ম। তার উপর "সমাজ" তো আছেনই সবজায়গায়।
সেখান থেকে ঘৃনাটা আস্তে আস্তে দূর হয়েছে কিন্তু অস্বস্তিটা ছিলো। সেই অস্বস্তির জায়গা থেকেই দেখেও না দেখার ভান করে আমি ওদের সম্পর্ক থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলাম। ভাইয়ার সাথে বন্ধুর মতোই সম্পর্ক ছিলো কিন্তু ওর জীবনের ওই অধ্যায়টা আমরা সবসময়ই এড়িয়ে চলতাম।

ওই মানুষটার সাথে শুধু পরিবারের মধ্যে মায়েরই যোগাযোগ ছিলো। ভাইয়াও একমাত্র ওর এই দূর্বল জায়গাটা নিয়ে একটু মায়ের সাথেই প্রানখুলে কথা বলতে পারতো। আমরা পরিবারের বাকি সবাই জানতাম কিন্তু আমাদের "মান-মর্যাদায়" আঘাত দেওয়ার মতো কোন ঘটনা হলেই আমরা জানতাম, আলোচনা করতাম, সমাধান খুঁজতাম। বাকিসময় কিছুই জানতাম না। আমি এখনও শতভাগ শিওর না, আমার ভাইয়ের হত্যার সঠিক মোটিভ কি। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে, আমি অপেক্ষায় আছি।
তবে আমি নিজের অপরাধ টা বুঝি। আর বুঝি বলেই আমি সমাজের চোখে অপরাধী। আর যেদিন বুঝিনি সেদিন অপরাধী ছিলাম না। কিন্তু ভাইয়ের অর্ধগলিত লাশের ছবি আমাকে দেখতে হয়েছে। ছবিটা একবার দেখার পরই ডিলিট করে দিয়েছিলাম। নতুবা সমাজের উদ্দেশ্য দিয়ে দিতাম।
আমি জেনেও সেদিন নিজেকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলাম, ওটা ভাইয়ার লাশ নয়। ভাইয়া বেঁচে আছে। এতো বছর ধরে চেনা মানুষটার শরীরটা ফুলে উঠলে আর মুখটা বিকৃত থাকলেও কি আমার মস্তিষ্ক চিনবে না। চিনেছিলো কিন্তু অস্বীকার করেছিলো। ডিএনএ টেস্ট পর্যন্ত আশা রেখেছিলো। মানুষ তো আশা নিয়ে ই বাঁচে।
আজকে আমি বুঝি, একজন হেটারোসেক্সুয়াল মানুষ হিসেবে আমি একজন নারীর সাথে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স করতে যতটা উৎসাহী, যতটা আনন্দ পাই ঠিক তেমনই একজন হোমোসেক্সুয়াল মানুষ তার সম লিঙ্গের মানুষের প্রতি একই অনুভূতি পায়।
আবার আমার যেমন সম লিঙ্গের অর্থাৎ পুরুষের সাথে সেক্স কল্পনা করতেও অস্বস্তি হয়, একধরনের নোংরা মনে হয় ঠিক তেমনি হোমোসেক্সুয়াল মানুষেরও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি এমন অনুভূতি হয়।
বিষয়টা শুধু এখানেই শেষ নয়। আরও অনেক বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। সেই ব্যাখ্যা অনলাইনে একটু সার্চ করলেই যে কেউ খুঁজে নিতে পারে।
আমি জানি না আমার ভাই হোমোসেক্সুয়াল ছিলো কিনা। যতদিন জীবিত ছিলো খুব একটা ভাবনায়ও আসে নি। কিন্তু এখন আমি জানি ভাবনাটা আসা উচিত ছিলো, সকলের আসা উচিত ছিলো। একটা সমাজের প্রতিটি মানুষ মিলেই সমাজ। জাতি,ধর্ম,বর্ন নির্বিশেষে সবারই সমাজে সম্মানের সাথে বাঁচার অধিকার রয়েছে।
মৃতরা কখনও ফিরে আসে না। আমার প্রিয়জনেরা কেউই ফিরে আসবে না। একদিন আমিও মরে যাবো। একেবারেই শূন্যে মিলিয়ে যাবো। কিন্তু যতটুকু সময় বেঁচে আছি একটা সুস্থ পৃথিবীতে বাঁচতে চাই। আমি জানি আগামীতে সকল মানুষই এরকম পৃথিবীতে বাঁচতে চাইবে। সেটা খুব দ্রুত হোক সেটাই প্রত্যাশা।

Comments

Popular posts from this blog

বাতাসে বারুদের গন্ধ

স্কুল ড্রেস